প্রশ্নফাঁস, নকল ও কোচিং বন্ধের উপায়



পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ নকলের বিষয়গুলো গত কয়েকবছর ধরেই জোরালো আলোচনা হলেও তা বন্ধে এখনও তেমন কোন উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, একটি অসাধু মহল তাদের অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতেই এমনটা করছেন। অনেক শিক্ষক আবার স্কুলে বা শ্রেণীকক্ষে ছাত্রদের পড়াশুনা না করিয়ে অর্থ উপার্জনে নিজেদের মতো গড়ে তুলছেন কোচিং সেন্টার। স্কুলগুলোর ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে সারাবছর শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা থেকে বিরত থাকলেও চূড়ান্ত পরীক্ষার আগ মুহূর্তে বেপরোয়া হয়ে উঠছে ভালো ফলাফলের জন্য।

শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলিত ধারা পরিবর্তন করা হলে এ অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব। শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতিকল্পে, প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ নকল বন্ধে কতিপয় পরামর্শ দিয়ে প্রাবন্ধিক-গবেষক ড. মঞ্জুরে খোদা ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন।

সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘‘প্রশ্নপত্র ফাঁস ও নকল বন্ধ, কোচিং বাণিজ্য দূর করতে, পরীক্ষাপদ্ধতির আমুল পরিবর্তন দরকার। কেন প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়? কেন নকল হয়? কেন কোচিং বাণিজ্য বন্ধ হয় না? কারণ শিক্ষার্থীর মাথায় একটি বিষয়ই সেই সময় কাজ করে তা হচ্ছে, কোন মূল্যে তাকে কৃতকার্য হতেই হবে, ভাল করতেই হবে! সারাবছর সে স্কুল-ক্লাসে যা করুক না কেন চুড়ান্ত পরীক্ষার মাধ্যমেই বিষয়টি নির্ধারিত হবে। এই মনোভাবই ছাত্রদের বেপরোয়া করে এবং অনৈতিক পথের সন্ধান করে! আর একশ্রেণীর অসাধু সুযোগসন্ধানী এই অবস্থার সুযোগ নেয় এবং অনৈতিক বাণিজ্য করে। বছরব্যাপী ধারাবাহিক স্কুল পারফরমেন্সের মাধ্যমে, মেধার মূল্যায়ন হলে, এই বিপদজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না।

১. কেমন পরীক্ষা পদ্ধতি দরকার
একেকটি সাবজেক্ট ১০০ মার্কের হলে, সারাবছর ক্লাস, লেকচার, টেস্ট, প্রেজেনটেশন, প্রজেক্ট, এ্যাসাইন্টমেন্ট, এক্সারসাইজ ইত্যাদির জন্য ৭০ শতাংশ মার্কস বরাদ্দ থাকবে, আর চুড়ান্ত পরীক্ষার জন্য বরাদ্দ থাকবে ৩০ শতাংশ মার্কস। তারমানে একজন ছাত্রকে পাশ করতে হলে, তাকে অবশ্যই সারাবছর ক্লাসের বিষয়গুলো অনুসরণ করতে হবে। মেধা ও পাশ-ফেলের বিষয়টি সেখানেই নির্ধারিত হবে। সারাবছরের ৭০ শতাংশ নাম্বারের সাথে চুড়ান্ত পরীক্ষার ৩০ শতাংশ নাম্বার যুক্ত হয়ে চুড়ান্ত মেধার গ্রেডিং নির্ধারিত হবে। কেউ যদি কোন কারণে চুড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ না নিতে পারে, তাহলেও সে কৃতকার্য হতে পারে, যদি সে পাশের সর্বনিম্ন নাম্বার অর্জন করে। অনেক উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে পরীক্ষাপদ্ধতির এই স্বীকৃত ধারা বিদ্যমান।

২. স্কুলই হবে লেখাপড়া প্রাণকেন্দ্র
লেখাপড়ার জন্যই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্যই লেখাপড়া! অফিস যেমন কাজের জন্য। বাসাবাড়ী হচ্ছে থাকার জন্য। গৃহ হবে পারিবারিক সময়ের জন্য। দৃষ্টিভোঙ্গী হতে হবে ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই তাদের লেখাপড়ার কাজগুলো শেষ করবে। লেখাপড়া, জ্ঞানার্জন, গবেষণা ও সেগুলোর যথাযথ জানাবোঝার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। বইগুলো থাকবে তাদের কাছে বা লাইব্রেরীতে রেফারেন্সের জন্য, কাজের জন্য। কোন বিষয় মুখস্ত করে মাথায় নিয়ে ঘোরার দিন শেষ। এখন তথ্যপ্রাপ্তির উৎস এত সহজ যে, তা আর মস্তিষ্কে নিয়ে ঘোরার বিষয় নয়। কেবল জানা থাকতে হবে’ প্রয়োজনের সময় জ্ঞানকে কাজে লাগানোর বহুমাত্রিক কৌশল, পদ্ধতি ও দক্ষতা।

৩. ক্লাসের সময় ও বিষয়ে গতানুগতিকতা নয়
ক্লাসের সময় বাড়াতে হবে। একেকটি ক্লাস হবে ৭৫ থেকে ৯০ মিনিট। এবং প্রতিদিন ৩ থেকে ৪টি বিষয়ে ক্লাস হবে। একই দিনে ৮-১০ বিষয়ে ক্লাস হওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য মানসিক চাপ, এবং টানা অনেক গুলো বিষয় পড়ানো-শেখানো বিজ্ঞানসম্মতও নয়। কেবল লেকচারভিত্তিক ক্লাস নয়, অংশগ্রহন, রিফ্রেশমেন্ট, আনন্দময় ও বন্ধুত্বমুলক করতে হবে।

৪. পাঠ্যপুস্তকের ধারা ও বিষয় বিন্যাস জরুরি
পাঠ্যপুস্তকের ভার-বোঝা কমাতে হবে। শিশুকাল থেকেই ৩-৪টি ভাষা ও অনেকগুলো বিষয় পড়ার চাপে তাদের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। শেখা ও জানার আনন্দ তাদের কাছে আতঙ্কের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কেবল ভাষা শিক্ষা ও অংকের খেলা ওদের জন্য বাধ্যতামুলক হওয়া উচিত। তারসাথে থাকবে আঁকাআঁকি, খেলাধূলা, গানবাজনা, পর্যায়ক্রমে, সমাজ, বিজ্ঞান, প্রকৃতি, পরিবেশ, নীতিশিক্ষা, কম্পিউটার, কলাসহ নিত্য নতুন বিষয় যুক্ত করতে হবে। শিশু-কিশোররা যে করতে ভালবাসে সে সব বিষয় যুক্ত করতে হবে, আঁকাআঁকি, ফটোগ্রাফি, ডিজাইন, শেলাইপরাই, কম্পিউটার, সঙ্গীত, যন্ত্র, শিল্পকলা, হাতের কাজ, বাগান, বাণিজ্য, রান্না ও পুষ্টি, পশুপাখী, প্রাণপ্রকৃতি ইত্যাদি।

৫. তত্ত্ব নির্ভরতা ও বইয়ের ভাবনা থেকে শিক্ষাকে বের করতে হবে
শিক্ষার্থীদের মাথা থেকে বইয়ের ভাবনা সরিয়ে রাখতে হবে। জানাতে হবে জ্ঞান সর্বত্র, বই তার সূত্রবদ্ধ রুপ মাত্র। এখানে প্রাইমারী স্কুলের (৮ ক্লাস পর্যন্ত) ছেলেমেয়েদের প্রতিদিন বাসা-স্কুল বই টানাটানি করতে হয় না! স্কুলেই তাদের সব। সেখানেই তাদের লেখাপড়ার সবকিছু। তাদের কাছে থাকে কেবল খাতা-কলম-পেনসিল-নোট। প্রয়োজনে তারা স্কুল থেকে বই ধার নেয়। শিক্ষাকে তত্ত্ব নির্ভরতার ধারা থেকে বের করে, তাকে ব্যবহারিক, মানবিক ও উৎপাদনমূখী করাটা খুব জরুরি।

0 Response to "প্রশ্নফাঁস, নকল ও কোচিং বন্ধের উপায়"

Post a Comment

Iklan Atas Artikel

Iklan Tengah Artikel 1

Iklan Tengah Artikel 2

Iklan Bawah Artikel